থার্টি ফার্স্ট নাইট সম্পর্কে ইসলাম কি বলে

থার্টি ফার্স্ট নাইট নামটি শুনলে আমরা মূলত একটি উৎসব বা আনন্দের দিন হিসেবে মনে করে থাকি। কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে কি এটি মানা সঠিক ও এর পেছনের ইতিহাসই বা কি? তো চলুন আজকে জেনে নিন থার্টি ফার্স্ট নাইট ইসলামিক দৃষ্টিতে কেমন এবং কেন এটি হারাম হিসেবে বিবেচিত।

ইসলামের দৃষ্টিতে থার্টি ফাস্ট নাইট পালন করা জায়েজ নয়, কারণ এটি মূলত বিধর্মী বা পশ্চিমা উৎসব। ৩১শে ডিসেম্বর রাতে নতুন বছরের আগমনের জন্য যে আনন্দ উৎসব পালন করা হয় তাকেই মূলত থার্টি ফার্স্ট নাইট বলে। ইতি মূলত পশ্চিমা বিশ্বের একটি সংস্কৃতি।

পোস্ট সূচিপত্রঃ থার্টি ফার্স্ট নাইট সম্পর্কে ইসলাম কি বলে

থার্টি ফাস্ট নাইট মূলত কি

থার্টি ফাস্ট নাইট হলো ইংরেজি বছরের শেষ রাত। এটিকে ইংরেজি নববর্ষ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। ইংরেজি মাসের কথা উল্লেখ করলে এর শুরু হয় জানুয়ারি মাস দিয়ে এবং শেষ হয় ডিসেম্বর মাস দিয়ে। আর এই ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখ রাতকে থার্টিফার্স্ট নাইট বলা হয়। থার্টিফার্স্ট নাইট কেউ মূলত পুরনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমন স্বরূপ একটি আনন্দ উৎসব হিসেবে ধরা হয়। পশ্চিমা সংস্কৃতির মানুষরা এই দিনকে একটি আনন্দ উৎসবের দিন হিসেবে পালন করে থাকে।

  • পশ্চিমা বিশ্বে এই রাতকে “New Year’s Eve” বলা হয়, আর বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশে একে নিজেদের মতো করে  “থার্টিফার্স্ট নাইট” বলা হয়।
  • প্রচলিত ধারণায় এই রাতটি নাচ-গান, পার্টি, বিনোদন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা কিংবা আতশবাজি ফোটানোর মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। যা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কাজ।

সুতরাং এটি স্পষ্ট যে থার্টিফার্স্ট নাইট ইসলামিক সংস্কৃতির নয় বরং এটি পশ্চিমা বিশ্বের একটি সামাজিক রীতি মাত্র।\


থার্টি ফার্স্ট নাইটের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট    

থার্টি ফার্স্ট নাইট ধারণাটি এসেছে নতুন বছরের আগমনী রাতের স্থানীয় যে উৎসব সংস্কৃতি তা থেকে। সংগীত, নৃত্যও শিল্পকলা কে এর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হয়। ১৮৫২ সালে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের হাত ধরে এই থার্টিফার্স্ট নাইট পালন শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে এটি পুরো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আর আধুনিক থার্টি ফার্স্ট নাইট বলতে মূলত নাজগান পার্টি ইত্যাদি কে বোঝায়। থার্টি ফাস্ট নাইটের উৎস খুঁজতে গেলে দেখা যায় —

  • রোমান সভ্যতায় Janus নামে এক দেবতার পূজা করা হতো, যাকে তারা বছরের শুরু ও শেষের দেবতা মনে করত। জানুয়ারি মাসের নামও এই Janus থেকেই এসেছে।
  • ইউরোপে খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে পড়ার পর নতুন বছরের উৎসব খ্রিস্টানদের মধ্যেও প্রবেশ করে। ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগরি “Gregorian Calendar” চালু করার মাধ্যমে ১ জানুয়ারিকে নতুন বছরের সূচনা ঘোষণা করেন।
  • ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে (১৮৫২ সালের পর থেকে) ইউরোপ ও আমেরিকায় জনসম্মুখে নতুন বছর উদযাপন শুরু হয়। এরপর দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

থার্টি ফার্স্ট নাইট শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ থেকে। ইংরেজি Thirty-First অর্থ ৩১ এবং Night অর্থ রাত শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে থার্টি ফার্স্ট নাইট কথাটি এসেছে। অর্থাৎ নতুন বছরের আগের রাত, ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ৩১ তারিখ রাত। আজকের থার্টিফার্স্ট নাইট মূলত পশ্চিমা বিশ্বের এই দীর্ঘদিনের সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। আর এভাবেই মূলত থার্টি ফাস্ট নাইট এর আগমন ঘটে। এই পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতি আজ ব্যাপকভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।


ইসলামিক দৃষ্টিতে থার্টিফার্স্ট নাইট বিশ্লেষণ

ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম এবং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামে উৎসব আনন্দ বা সামাজিক অনুষ্ঠান সব কিছুরই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কিন্তু তা হতে হবে ইসলামের নির্দেশনা মেনে। যেমন:- 

  • আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন যে ইসলামে নির্ধারিত উৎসব কেবল দুইটি : ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।
  • এর বাইরে কোনো দিন বা রাতকে ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব হিসেবে পালন করা বিদআত বা নকল।
  • কোরআনে আল্লাহ বলেন: “তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার পরও তার নিয়ম-কানুন ভুলে গিয়েছিল।” (সুরা আ’লি ইমরান: ১০৫)
  • ইসলাম আমাদেরকে নিজস্ব সংস্কৃতি ও পরিচয়ে অবিচল থাকতে নির্দেশ দেয়।

সুতরাং বোঝা যায় যে ইসলামিক দৃষ্টিতে থার্টি ফাস্ট নাইট পালন করা হারাম একটি কাজ। সুতরাং মুসলিম হিসেবে আমাদের থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করা উচিত নয়।


বিভিন্ন হাদিসের আলোকে থার্টিফার্স্ট নাইট বিশ্লেষণ

এজন্য হাদিসের আলোকে থার্টিফার্স্ট নাইট পালন করা একটি হারাম কাজ। এই ধরনের উৎসব ইসলাম অনুমোদন করে না। হাদিসে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে যা অন্য জাতির সংস্কৃতির সাথে মিলে যায়। থার্টিফার্স্ট নাইটে অতিরিক্ত খরচ, নাচ-গান, আতশবাজি ইত্যাদি অপসংস্কৃতি জড়িত যা ইসলামে নিষিদ্ধ। থার্টি ফার্স্ট নাইট পালনের বিপক্ষে কিছু হাদিস থেকে যুক্তি তুলে ধরা হলো :

 অন্য জাতির অনুকরণ:

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে।”  (আবু দাউদ: ৪০৩১)

থার্টিফার্স্ট নাইট পালন করা আসলে বিধর্মীদের অনুসরণ করা। ইসলাম মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রাখতে বলেছে, অন্য জাতির অনুকরণ করা নিষিদ্ধ।

অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা:

রাসুল (সাঃ) বলেছেন— “আমার উম্মতের কিছু লোক থাকবে যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ্যপান ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে।”  (বুখারি: ৫৫৯০)

থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনে প্রায়ই অশ্লীল নাচ-গান, বেপরোয়া আড্ডা আর বেহায়াপনা দেখা যায়। ইসলাম এ ধরনের কাজ কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।

অপচয় ও অপসংস্কৃতি

“নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।”  (সূরা আল-ইসরা: ২৭)

এই রাতের পার্টি ও আনন্দ-উল্লাসে প্রচুর টাকা-পয়সা নষ্ট হয়। ইসলাম অপচয়কে ঘৃণা করে এবং একে অপসংস্কৃতি মনে করে।

উল্কি আঁকা ও নকল চুল ব্যবহার

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসুল ﷺ অভিশাপ দিয়েছেন— “যারা উল্কি আঁকে ও আঁকায়, যারা মুখমণ্ডল থেকে লোম তুলে এবং যারা চুলে নকল চুল জুড়ে দেয়।”  (বুখারি: ৫৫৯৮, মুসলিম: ২১২৫)

থার্টিফার্স্ট নাইটে অনেক সময় শরীরে উল্কি আঁকা বা নকল চুল ব্যবহার করা হয়। এগুলো ইসলামে হারাম কাজ।

আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য উৎসর্গ

রাসুল (সাঃ) বলেছেন— “আল্লাহ তাআলা লানত করেছেন সেই ব্যক্তির উপর, যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নামে কোরবানি করে।”  (মুসলিম: ১৯৭৮)

ইসলামে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য কোনো কিছু উৎসর্গ করা যায় না। যদিও থার্টিফার্স্ট নাইট সরাসরি কোনো দেবতার নামে উৎসর্গ নয়, তবে এর শেকড় অমুসলিমদের সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হওয়ায় মুসলমানদের জন্য এটি মানা উচিত নয়।

থার্টিফার্স্ট নাইট পালন করা উচিত নয় কেন

থার্টিফার্স্ট নাইট পালন না করার প্রধান কারণ হলো এটি একটি বিধর্মী বা পশ্চিমা সংস্কৃতি, যার সাথে ইসলামি আদর্শ বা সংস্কৃতি কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইসলামি দৃষ্টিতে এটি একটি অপসংস্কৃতি এবং হারাম কাজ হিসেবে বিবেচিত, কারণ এখানে অপচয়, অবৈধ যৌনতা, অশ্লীলতা এবং দুষ্কর্মের মতো বিষয় জড়িত থাকে, যা ইসলামি মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাছাড়া এ ধরনের উদযাপন নাগরিক শান্তি নষ্ট করে এবং মানুষের অধিকার বা সৃষ্টির হক ক্ষুণ্ণ করে। তাই একজন সচেতন মুসলমান ও সভ্য মানুষ হিসেবে এটি সমর্থন করার কোনো সুযোগ নেই।

বিধর্মী সংস্কৃতি

থার্টিফার্স্ট নাইট মূলত পশ্চিমা সমাজ থেকে আগত একটি প্রথা। এটি ইসলামের সংস্কৃতি নয়। মুসলমানরা যখন এ রাত উদযাপন করে, তখন তারা মূলত বিধর্মীদের অনুসরণ করে, যা ইসলাম অনুমোদন করে না।

হারাম বা নিষিদ্ধ

বিশ্বজুড়ে ইসলামি আলেম ও গবেষকরা একমত যে, থার্টিফার্স্ট নাইটের মতো উদযাপন শরিয়তসম্মত নয়। এটি এমন একটি রীতি, যাকে ইসলাম হারাম বা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছে।

অপসংস্কৃতি

এই রাতের আনন্দ-উল্লাসকে ইসলামি দৃষ্টিতে অপসংস্কৃতি হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে শালীনতা, সংযম, ইবাদত বা পরহেজগারির কোনো চর্চা নেই, বরং থাকে বেহায়াপনা, হৈ-হুল্লোড় এবং সীমালঙ্ঘন।

ইসলামের উৎসব নয়

ইসলামি শরীয়তে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত উৎসব কেবল দুটি—ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। এর বাইরে অন্য কোনো দিবস বা রাতকে আনন্দ-উৎসব হিসেবে পালনের বিধান নেই। তাই থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন মুসলিম পরিচয় ও বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

অশ্লীলতা ও অপচয়

এ রাতের পার্টি, নেশা, অবৈধ সম্পর্ক, অশ্লীলতা, অপচয় ও অপব্যয় মুসলিম সমাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ইসলাম প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ ও অপচয় বর্জনের শিক্ষা দিয়েছে, অথচ এ রাতে ঠিক তার বিপরীত আচরণ করা হয়।

শান্তি নষ্ট করা

থার্টিফার্স্ট নাইটের কারণে প্রায়ই নাগরিক শান্তি নষ্ট হয়। সড়কে বিশৃঙ্খলা, দুর্ঘটনা, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ এবং অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। যা সামাজিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করে।

ইসলামভিত্তিক নতুন বছরের আগমন

মুসলমানদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি হলো হিজরি ক্যালেন্ডার। আমাদের নতুন বছর শুরু হয় মহররম মাসের প্রথম দিন থেকে। এ দিনটি কেবল তারিখ পাল্টানোর একটি দিন নয়, বরং এটি আমাদের জন্য আত্মসমালোচনা, তওবা এবং নতুন সংকল্প গ্রহণের একটি সুযোগ।

প্রতিটি মুসলমানের উচিত, নতুন বছরের শুরুতে নিজের অতীত জীবনের দিকে ফিরে তাকানো। গত বছর আমি কতটুকু আল্লাহর হুকুম মানতে পেরেছি? কোথায় কোথায় গুনাহে জড়িয়েছি? কারো হক নষ্ট করেছি কি না?—এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করা জরুরি। যদি ভুল হয়ে থাকে, তবে আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া এবং নতুন বছরে নেক আমল করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা একজন মুমিনের করণীয়।

নবীজি (সাঃ) এর হিজরত আমাদের জন্য বিশেষ শিক্ষা বহন করে। হিজরতের মধ্যে রয়েছে সংকল্প, আত্মত্যাগ, ধৈর্য এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার শিক্ষা। তিনি মক্কার সমস্ত কষ্ট ও নির্যাতন পেছনে ফেলে মদিনায় গিয়ে ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। সেই ঐতিহাসিক ঘটনাই আজকের হিজরি সনের সূচনা। তাই নতুন হিজরি বছর আমাদের জন্য কেবল সময়ের হিসাব নয়, বরং জীবন গড়ার অনুপ্রেরণা।

ইসলামে নতুন বছর উদযাপন মানে কোনো হৈ-হুল্লোড়, নাচ-গান বা অশ্লীল পার্টি নয়। বরং এর আসল অর্থ হলো—নিজেকে সংশোধন করা, অতীতের গুনাহ থেকে ফিরে আসা এবং আগামীর জন্য সৎকর্মের অঙ্গীকার করা। আল্লাহর কাছে দোয়া করা যে, নতুন বছর যেন ইমান, আমল, তাকওয়া ও বরকতের বছর হয়।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ইনকাম মিক্স টেক এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url