এক বাংলাদেশির দৃষ্টিকোণ থেকে দুবাই ভ্রমণের প্রথম অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশের যে কোনো মানুষের জীবনে বিদেশ ভ্রমণ একটি বড় স্বপ্নের মতো। বিশেষ করে যারা ছোট শহর বা গ্রাম থেকে উঠে বড় শহরে আসেন, তাদের কাছে এই স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। বিদেশ ভ্রমণ শুধু নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্য গর্ব এবং অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবেও কাজ করে। আমি অনেক বছর ধরে দুবাই ভ্রমণের পরিকল্পনা করছিলাম, যা ২০২২ সালের আগস্টে পূরণ হলো।

এই লেখায় আমি আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করব, যা বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষ অর্থ বহন করে।বাংলাদেশের গ্রামীণ ও ছোট শহর থেকে বড় শহরে উঠে আসা মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্ন জড়িয়ে রয়েছে একটি বিশেষ মানসিকতা ও আশা। এই ভ্রমণ শুধুমাত্র ভৌগোলিক স্থান পরিবর্তন নয়, এটি নিজেকে যাচাই করার, নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এবং জীবন মান উন্নয়নের প্রতীক। আমি নিজেও সেই সাধারণ ব্যাক্তি, যার জীবনে এই ভ্রমণ ছিল স্বপ্নের বীজ। আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হওয়ায় আমি অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে চাই যেন অন্যরাও অনুপ্রাণিত হন।

পোস্ট সূচিপত্রঃ দুবাই: এক আধুনিক মরুভূমির মায়াবী নগরী

দুবাই: এক আধুনিক মরুভূমির মায়াবী নগরী

দুবাই হলো মধ্যপ্রাচ্যের এক আধুনিক শহর, যা মরুভূমির বুকে স্বপ্নের মতো গড়ে উঠেছে। এখানকার আকাশচুম্বী টাওয়ার, বিলাসবহুল হোটেল, আর উন্নত পরিকাঠামো বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। দুবাই শুধু পর্যটনের জন্য নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক মিলনের কেন্দ্রবিন্দুও বটে। দুবাইয়ের রূপকথা দেখে প্রথমে মনে হয়, এ যেন এক ভিন্ন জগতের শহর। বিশাল আকাশচুম্বী টাওয়ার বুর্জ খলিফা, জাহাজাকৃতির বিলাসবহুল হোটেল বুর্জ আল আরব, বিশ্বের বড়মাপের শপিং মল, আর মরুভূমির মাঝে সাজানো ডেজার্ট সাফারি—সবকিছুই এক অপরূপ সৌন্দর্য্য।

মরুভূমির মাঝে গড়ে ওঠা এই নগরী আমার কাছে মানব সভ্যতার এক চমকপ্রদ সৃষ্টি মনে হয়েছে। প্রাচীন ঐতিহ্য আর আধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধন এখানে অসাধারণ। সৌদি আরব ও বাহরাইন, কুয়েত, ওমানের পাশাপাশি দুবাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র, যেখানে হাজার হাজার জাতি একসঙ্গে বসবাস করে। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষদের মিলনমেলা এই শহর। এর ফলে এখানকার খাবার, ভাষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা সবকিছুতেই বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।

ভ্রমণের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা

ভিসা প্রক্রিয়া

দুবাই যেতে হলে ভিসা প্রয়োজন, যা বর্তমানে বেশ সহজ। ইন্টারনেট থেকে অনেক ভিসা এজেন্সির মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করে দ্রুত পেয়ে যাওয়া যায়। আমি নিজেও অনলাইনে সহজেই ভিসা সংগ্রহ করেছি। অবশ্য ভিসার ধরন অনুযায়ী ভ্রমণের উদ্দেশ্য (পর্যটন, ব্যবসা, চিকিৎসা ইত্যাদি) ভিসার ধরণ বেছে নিতে হবে।

ভিসা প্রক্রিয়ায় আপনাকে সঠিক তথ্য দিতে হবে এবং ফটোগ্রাফ, পাসপোর্ট স্ক্যান, ব্যাংক স্টেটমেন্ট ইত্যাদি সংযুক্ত করতে হয়। অনলাইনে আবেদন করার সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি, যেমন অফিসিয়াল ওয়েবসাইট বা বিশ্বাসযোগ্য এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করা, যা ভিসা পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। বাংলাদেশ থেকে দুবাই পর্যটন ভিসা সাধারণত ৩০ দিন মেয়াদের হয় এবং দরকার পড়লে একাধিকবার নবায়নও করা যায়।

ফ্লাইট বুকিং

ঢাকা থেকে দুবাই যাওয়ার সরাসরি ফ্লাইট বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স পরিচালনা করে। আমি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের BG341 ফ্লাইটটি নিয়েছিলাম, যেটি সময়ে সুবিধাজনক এবং সেবাও ভালো ছিল। ফ্লাইট বুকিং করার সময় পূর্বেই নিশ্চিত হওয়া ভালো, বিশেষ করে সিজনের ওপর ভাড়া অনেক পরিবর্তিত হতে পারে।

ফ্লাইটের সময় ও খরচ সঠিকভাবে পরিকল্পনা করলে আরামদায়ক যাত্রা নিশ্চিত হয়। সিজনের ওপর নির্ভর করে টিকিটের দাম ব্যাপকভাবে ওঠানামা করে, বিশেষ করে উৎসবকালীন সময়ে। আমি বেশ কয়েক মাস আগে বুকিং করে নিয়েছিলাম, যা আমাকে ভালো মূল্য পেয়েছিলাম। এছাড়া বিমানবন্দরে পৌঁছানোর আগে ব্যাগেজ ও অন্যান্য নিয়মাবলী ভালোভাবে জেনে রাখা উচিত।

সিটি ট্যুর ও অন্যান্য টিকেট বুকিং

দুবাই ভ্রমণের জন্য বিভিন্ন জনপ্রিয় স্থানের টিকেট আগে থেকেই অনলাইনে বুক করে নিলে সময় ও খরচ দুটোই বাঁচে। আমি আমার সিটি ট্যুর ও বুর্জ খলিফা, ফিশ অ্যাকুরিয়াম, ডেজার্ট সাফারি ইত্যাদির টিকেট অনলাইনে বুক করে নিয়েছিলাম।

অনলাইনে টিকেট কেনার সুবিধা হলো দীর্ঘ লাইন এড়ানো এবং দামেও অনেক সময় ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। আমি গুগল রিভিউ দেখে, বিভিন্ন ব্লগ পড়ে সেরা সাইট ও ট্যুর গাইড বেছে নিয়েছিলাম। ট্যুর গাইড যদি বাংলা বা হিন্দি ভাষায় হয়, তখন সুবিধা অনেক বেশি। এছাড়াও, সিটি ট্যুরে কোন কোন জায়গা অন্তর্ভুক্ত আছে এবং সেখানে কতো সময় ব্যয় হবে সেটাও আগে থেকে জানা দরকার।

ঢাকা থেকে দুবাই: আমার যাত্রাপথ

২৮ আগস্ট ২০২২, সন্ধ্যা ৬ টায় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটে চড়ে শুরু হলো আমার দুবাই যাত্রা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবলাম, জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের শুরু। পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে রাত ১১টার দিকে দুবাই বিমানবন্দরে পৌঁছলাম।

বিমানবন্দরে পৌঁছানোর আগে নিরাপত্তা ও অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা জরুরি। দুবাই বিমানবন্দর বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত ও আধুনিক বিমানবন্দর, যেখানে যাত্রীদের দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন আধুনিক সুবিধা রয়েছে। আমি জানতাম না বিমানবন্দর থেকে কিভাবে চলাচল করতে হবে, কিন্তু স্থানীয় নির্দেশিকা ও পর্যটক সহায়করা খুবই সহযোগী ছিল।

দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর: আধুনিকতার এক নজির

বিমানবন্দরটি অত্যন্ত বিশাল, পরিষ্কার ও আধুনিক। ইমিগ্রেশন ও অন্যান্য প্রক্রিয়া দ্রুত ও ঝামেলাহীন ছিল। বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাত্রার তুলনায় এখানে সবকিছু অনেক সুসংগঠিত এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।

বিমানের ভিতরে প্রথমবার যাতায়াতের পর বিমানবন্দরে প্রথম যা নজর কেড়েছিল তা হলো স্বয়ংক্রিয় চেক-ইন কিওস্ক, যার মাধ্যমে অনেক দ্রুততার সঙ্গে টিকিট প্রসেসিং হয়। এছাড়া ব্যাগেজ সংগ্রহের এলাকা, সিকিউরিটি চেক পয়েন্ট এবং সাইনেজগুলো এতটাই সুস্পষ্ট যে একজন নতুন পর্যটকও সহজে পথ খুঁজে নিতে পারে। এই আধুনিক ব্যবস্থা আমাদের দেশে খুব কমই দেখা যায়, যা দেখে একরকম বিস্ময়কর লাগল।

শহরে প্রবেশ: দুবাইয়ের আলোকিত রাস্তাঘাট ও ট্রাফিক ব্যবস্থা

ট্যাক্সি নিয়ে শহরে ঢোকার সময় চোখে পড়ল দুই দিকের উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর আলোকিত রাস্তাঘাট। শহর যেন রাতের আঁধারে জ্বলে উঠেছে। দুবাইয়ের ট্রাফিক ব্যবস্থা আমার জন্য বড় এক শিক্ষা ছিল। বাংলাদেশের মতো যানজট এখানে প্রায়ই দেখা যায় না। রেড সিগন্যাল মানা হয়, সাইডওয়াকে চলাচল গুছিয়ে রাখা হয় এবং ট্রাফিক পুলিশের কাজ অনেকাংশে প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।

আমি দুবাইতে শহরের ভিতর ট্রাফিক নিয়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, বাসিন্দাদের মধ্যে ভদ্রতা, ড্রাইভিং নিয়মকানুন মানার প্রবণতা এবং যানজট কম থাকার কারণে গাড়ি চালানো অনেক সহজ। বাংলাদেশের মতো অনিয়ম এবং হর্ন বাজানোর অভাব আমাকে ভিন্ন পৃথিবীতে নিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া রাস্তার পাশে দাঁড়ানো ফুটপাত, ট্রাফিক লাইটের সময়ের সঠিক নিয়ন্ত্রণ এবং যানজট কমানোর জন্য উন্নত পরিকল্পনা বিশেষভাবে নজর কেড়েছে।

আমার হোটেল: Radisson Blu Waterfront

রাত দুইটার সময় পৌঁছে হোটেলে আরাম করলাম। হোটেলটি শহরের কেন্দ্রে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সব ধরনের সুবিধা সমৃদ্ধ। হোটেলের সুবিধাগুলো যেমন ফ্রি ওয়াইফাই, সুইমিং পুল, জিম, রেস্টুরেন্ট ছিলো, যা আমাকে অতিরিক্ত আরাম দিয়েছিল। ঘরের বড় জানালা থেকে নদী আর শহরের রাতের আলো দেখা যায়। এমন আরামদায়ক পরিবেশের অভাব বাংলাদেশে অনেক সময় অনুভব করি, তাই এখানে থাকার অভিজ্ঞতা বেশ ভালো লাগল। এছাড়াও, হোটেলের কর্মচারীরা অতিথিপরায়ণ ও সদয় ছিলো, যাদের সাহায্যে স্থানীয় দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য পেয়েছি।

দুবাইয়ের প্রথম দিন: সিটি ট্যুর ও দর্শনীয় স্থান

দুবাইয়ের সিটি ট্যুর আমার প্রথম দিন ছিল স্মরণীয়। দুটি গ্রুপে আমি অংশ নিয়েছিলাম যেখানে আমরা বিভিন্ন বিখ্যাত স্থান ঘুরে দেখলাম:

  • দুবাই মিউজিয়াম: দুবাইয়ের পুরনো জীবন ও সংস্কৃতির পরিচয়।

  • দুবাই ফ্রেম: আধুনিক ও পুরনো দুবাইয়ের একসাথে দৃশ্য দেখতে পারা যায়।

  • জুমেইরা মসজিদ: স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন।

  • জুমেইরা বিচ: বিশ্রামের জন্য এক চমৎকার স্থান।

  • মেরিনা ক্রুজ: জলযাত্রার মাধ্যমে দুবাইয়ের জলরাশি দেখার সুযোগ।

  • বুর্জ আল আরব: বিলাসবহুল হোটেল, বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে চমকপ্রদ স্থাপত্য।

রাতের বেলা দুবাই মল ও বুর্জ খলিফার সামনে জলক্রীড়া ও লাইট শো দেখলাম। এসব দেখে মনে হলো, দুবাই যেন সত্যিই রাতের আলোতে এক অন্য রূপে বদলে যায়।সিটি ট্যুরের গাইড আমাদের দুবাইয়ের ইতিহাস ও আধুনিকতার মিশ্রণ সম্পর্কে গভীর তথ্য দিয়েছিলেন, যা বাংলাদেশ থেকে আসা আমার মতো পর্যটকের জন্য খুবই শিক্ষণীয় ছিল। বিশেষ করে দুবাই মিউজিয়ামে মরুভূমির জীবনধারা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া একটি নতুন অভিজ্ঞতা। দুবাই ফ্রেমের ওপর দিয়ে দাঁড়িয়ে পুরনো ও নতুন শহরের একসঙ্গে চিত্র দেখা সত্যিই মুগ্ধকর। জলক্রীড়া শোতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। এছাড়া স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ ও রাস্তার পাশের ছোট ছোট দোকান ঘুরে দেখা ইত্যাদি আমার স্মৃতিতে গেঁথে গেছে।

দ্বিতীয় দিন: বুর্জ খলিফা, ফিশ অ্যাকুরিয়াম ও শপিং

বুর্জ খলিফার ১২৬ তলা থেকে পুরো শহরের দৃশ্য উপভোগ করলাম। বিশ্বের সর্বোচ্চ টাওয়ারের ওপর থেকে দেখার অনুভূতি সত্যিই অতুলনীয়। দুপুরে দুবাই মলের ফিশ অ্যাকুরিয়ামে গেলাম। বিশাল অ্যাকুরিয়ামের ভিতরে হাঁটা, নানা প্রজাতির জলজ প্রাণী দেখা—সব কিছু মুগ্ধকর।বিকালে শহরের বিভিন্ন শপিং মলে ঘুরে আসলাম। 

বুর্জ খলিফার টিকিট আগে থেকে কিনে নেওয়ায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। এটির ১২৬ তলার দর্শনীয় জায়গা থেকে সূর্যাস্ত দেখা এক অন্যরকম অনুভূতি দেয়। দুবাই মল এত বিশাল যে পুরো দিনও সেখানে কাটানো যায়। ফিশ অ্যাকুরিয়ামে রঙিন ও বিরল মাছ দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি। শপিংয়ের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশি পণ্যের তুলনায় দুবাইয়ের মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ড, সস্তা ও দামী দুই ধরনের পণ্য সহজলভ্য। তবে বাংলাদেশিদের জন্য বাংলাদেশি বাজার বা পেঁচা মার্কেট আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে।

তৃতীয় দিন: গোল্ড সুক ও জুমেইরা বিচ

গোল্ড সুকে গিয়েছিলাম, যেখানে সোনার বিভিন্ন ডিজাইন আর গহনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলাম। বাংলাদেশিদের জন্য এটি কেনাকাটার অন্যতম প্রিয় স্থান। জুমেইরা বিচের সাদা বালি ও নীল জল প্রকৃতির এক অনবদ্য সৃষ্টি।গোল্ড সুকের দোকানগুলোতে দরাদরি করার সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশিদের মতো দরদাম আর বাজার করার অভ্যাস কাজে লেগেছিল। এখানকার সোনার গহনা গুণগতমানেও অনন্য। বাংলাদেশি পর্যটকদের অনেকেই এই জায়গা থেকে সোনার জিনিস কেনেন, কারণ দাম তুলনামূলক কম এবং বৈচিত্র্য অনেক বেশি।

জুমেইরা বিচে সূর্যাস্তের সময় আবহাওয়া এতটাই মনোরম ছিল যে, একেবারে ভিন্ন ধরনের প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম। সৈকতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বাংলাদেশের সৈকতগুলোর তুলনায় অনেক বেশি উন্নত।

চতুর্থ দিন: বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কা এশিয়া কাপ ম্যাচ

মাঠে বসে দেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখার আনন্দের তুলনা হয় না। যদিও বাংলাদেশ জিতেনি, তবুও মাঠের উন্মাদনা আর দেশপ্রেম মুগ্ধ করেছিল।

দুবাই ক্রিকেট স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক খেলার জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশি দর্শকদের উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছিলো আমরা এক পরিবার। বাংলাদেশের জন্য খেলা দেখে সবাই মিলে গলা ফাটানো, জয়-পরাজয়ের উল্লাস মিশিয়ে এক অপরূপ অভিজ্ঞতা। এখানে ক্রিকেটের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং সাংস্কৃতিক মিলন ঘটে। মাঠে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো দারুণ, যা মাঠের আনন্দকে দ্বিগুণ করেছিল।

পঞ্চম দিন: ডলফিন শো ও বার্ড শো

ডলফিনের খেলাধুলা দেখেছি, পাখিদের নানা অভিনব ভঙ্গি উপভোগ করেছি। প্রকৃতির সঙ্গে কাছাকাছি হওয়ার আনন্দ মনের গভীরে ছুঁয়ে গেছে। ডলফিন শোতে প্রাণীদের প্রশিক্ষণ এবং তাদের কৌশল দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এখানে পর্যটকদের জন্য অনেক ধরনের শো থাকে যা শিশুদের এবং বড়দের জন্য সমানভাবে আকর্ষণীয়। বার্ড শোতে বিভিন্ন প্রজাতির রঙিন পাখিদের নাচ, গান এবং ভঙ্গি দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। এই ধরনের শো পরিবেশ ও প্রাণী সুরক্ষার শিক্ষাও দেয়।



ষষ্ঠ দিন: মরুভূমি ডেজার্ট সাফারি

মরুভূমির বুকে সাফারি, উটের পিঠে চড়া, বালির ঢিবির মাঝে চলাফেরা—সব মিলিয়ে এক অসাধারণ রোমাঞ্চ। ডেজার্ট সাফারি ছিলো দুবাই ভ্রমণের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অংশ। মরুভূমির বালুতে গাড়ি চালানোর সময় গতি ও দোল খেয়ে কিছুটা ভয় পেলেও মজা পেলাম বেশি। সাফারি শেষে বুনো গার্মেন্টসের নাচ, খাবার আর গান-গানিতে রাত কাটালাম। এখানকার খাওয়ার স্বাদ বাংলাদেশি খাবারের কাছাকাছি হওয়ায় খুবই ভালো লেগেছে। মরুভূমির নির্জনতা ও শান্তি ভিন্ন এক অনুভূতি।

দুবাইয়ের খাবার ও সংস্কৃতি

দুবাইতে খাদ্যসংস্কৃতি বৈচিত্র্যময়। অধিকাংশ রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানি জনপ্রিয় হলেও ভারতীয় ও পাকিস্তানি খাবার পাওয়া যায় সহজে। বাংলাদেশিদের জন্য ভাত-ডালের অভাব বোধ হতে পারে।

দুবাইয়ের খাবারে বিভিন্ন দেশের স্বাদ মিশ্রিত। মাইক্রোওয়েভ থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী আরবীয় খাবার, এবং আন্তর্জাতিক ফাস্টফুডসহ সবকিছু পাওয়া যায়। আমি বেশ কিছু স্থানীয় আরব খাবার ট্রাই করেছিলাম, যেমন শাওর্মা, কাবাব এবং হুমাস। খাবারের দাম তুলনামূলক একটু বেশি হলেও স্বাদ অনেক ভালো। স্থানীয় রেস্টুরেন্টগুলোতে ধর্মীয় নিয়ম অনুসরণ করে খাবার পরিবেশন করা হয়।

স্থানীয় মানুষের সাথে মেলামেশা ও নিরাপত্তা

দুবাইতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্ত। স্থানীয়রা বিদেশিদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ। ভাষার দিক থেকে ইংরেজি প্রচলিত হওয়ায় যোগাযোগে অসুবিধা কম। দুবাইতে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ মিশে থাকে, যাদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সহনশীলতা লক্ষণীয়। সাধারণত নিরাপত্তা আইন কঠোর হওয়ায় অপরাধের হার অনেক কম। আমি কখনো নিজেকে অসুরক্ষিত মনে করিনি। পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মীরা সবসময় সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকে। এছাড়া ইংরেজি ভাষা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হওয়ায় যোগাযোগ সহজ হয়।

ভ্রমণ খরচ কমানোর টিপস

  • আগেভাগেই অনলাইনে টিকেট ও হোটেল বুক করুন।

  • পাবলিক ট্রান্সপোর্ট (মেট্রো) ব্যবহার করুন।

  • গাইডেড ট্যুরগুলো তুলনামূলক কম খরচে।

কিছু সময় দুবাইতে সস্তায় থাকার জন্য হোস্টেল বা বাজেট হোটেলও পাওয়া যায়। এছাড়াও খাবারের জন্য স্থানীয় স্ন্যাক বার ও ফুড কোর্ট ব্যবহার করলে খরচ কমে। ট্যাক্সির তুলনায় মেট্রো বেশি সাশ্রয়ী ও দ্রুতগামী। আমি গুগল ম্যাপস ও স্থানীয় অ্যাপস ব্যবহার করে সঠিক পথ নির্ণয় করেছি যা সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচিয়েছে।

আমার শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা ও শেষ কথা

দুবাই ভ্রমণ আমার জন্য এক মেধাসম্পন্ন অভিজ্ঞতা। এখানে আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের অনবিন্দু মিশেছে, যা বাংলাদেশের মানুষের জন্য অনেক কিছু শেখার। যারা বিদেশে যেতে চান, তাদের জন্য দুবাই আদর্শ গন্তব্য। শুধু আনন্দ নয়, শিক্ষা ও অনুপ্রেরণাও পাবে।

আমি আশা করি আমার অভিজ্ঞতা আপনারা উপভোগ করেছেন এবং আপনারা নিজেও একদিন এই রুপকথার শহর ঘুরে দেখবেন।

শুভ যাত্রা!


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ইনকাম মিক্স টেক এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url